প্রতিনিধি ২ আগস্ট ২০২৫ , ৬:৩০:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্রের পর এবার ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ অ-পরমাণু বোমা, আরও এক গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র প্রকাশ্যে এনে গোটা বিশ্বে ভয় ধরাল তুরস্ক। যুদ্ধবিমান থেকে ওই বোমা ছুড়ে মারলে চোখের নিমেষে গুঁড়িয়ে যেতে পারে শত্রু দেশের একাধিক শহর। পাশাপাশি, কৌশলগত পরিকাঠামো বা সামরিক ছাউনিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার ক্ষমতা রয়েছে বোমাটির। আর এতেই চিন্তার ভাজ পড়েছে ভারত-ইসরাইলসহ আমেরিকার কপালেও।
‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ খ্যাত তুরস্ক গত কয়েক বছরে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে চলা সংঘর্ষে বার বার খবরের শিরোনামে এসেছে একাধিক হাতিয়ার নিয়ে। সেই তালিকায় রয়েছে ‘বের্যাক্টার টিবি-২’ হামলাকারী ড্রোন থেকে শুরু করে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র।
এবার কি তাতে যুক্ত হলো আঙ্কারার তৈরি ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ অ-পরমাণু বোমা? নাকি কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান? উঠেছে এমন সব প্রশ্নও।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ১৭তম ‘আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা শিল্প মেলা ২০২৫’-এর আয়োজন করে তুর্কি প্রশাসন। সেখানেই ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ গণবিধ্বংসী অ-পরমাণু-সহ জোড়া বোমা প্রথমবার প্রকাশ্যে আনে আঙ্কারা। সেগুলোর একটির নাম গাজাপ। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ হলো- ক্রোধ। দ্বিতীয়টি হলো- হায়ালেট বা ভূত। দু’টি বোমাই তৈরি করেছে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন গবেষণা এবং উন্নয়নকেন্দ্র (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার)।
তুর্কি গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজাপের ওজন অনুমানিক দু’হাজার পাউন্ড বা ৯৭০ কেজি। শত্রুর ওপর আঘাত হানার সময় একসঙ্গে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে এর। বিস্ফোরণের সময় এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ১০ হাজার টুকরোয় ছড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এর নকশা তৈরি করেছেন আঙ্কারা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
সদ্য প্রকাশ্যে আসা বোমাগুলোর শক্তি প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন গবেষণা এবং উন্নয়নকেন্দ্রের ডিরেক্টর নিলুফার কুজুলু। ‘টার্কি টুডে’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রতি বর্গমিটারে বিপুল পরিমাণে স্প্লিন্টার ছড়িয়ে দিতে পারবে গাজাপ। একটি সাধারণ এমকে সিরিজের বোমার চেয়ে এটি তিন গুণ বেশি শক্তিশালী।’
সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই বোমাটির মধ্যে একটি পরিবর্তিত ফিলার এবং অভ্যন্তরীণ পাঁজরযুক্ত কাঠামো রয়েছে, যা এর বিস্ফোরণের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। গাজাপের নকশার সঙ্গে গ্রেনেডের কার্যকারিতার কিছুটা মিল রয়েছে। তবে এর ক্ষেত্রে এলোমেলোভাবে ইস্পাতের স্প্লিন্টার এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে না। উল্টে বিস্ফোরণের পর নিয়ন্ত্রিত টুকরোয় ভেঙে গিয়ে সেগুলো শত্রুর ওপরেই আঘাত হানে।
কুজুলু জানিয়েছেন, এফ-১৬ এবং এফ-৪ যুদ্ধবিমান থেকে শত্রুঘাঁটিতে গাজাপ ফেলে হামলা করতে পারবে তুর্কি বিমান বাহিনীর সদস্যরা। আগামী দিনে ড্রোন থেকে যাতে এই বোমা ব্যবহার করা যায় সেই চেষ্টাও চালাচ্ছেন তারা।
অন্য দিকে, হায়ালেটকে বাঙ্কার বাস্টার বোমা বলা যেতে পারে। কংক্রিট বা ইস্পাতের দেওয়ালের শক্ত কাঠামো ভেদ করে আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে একে তৈরি করেছেন আঙ্কারার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
বর্তমানে তুর্কি বিমান বাহিনী দু’টি বাঙ্কার বাস্টার বোমা ব্যবহার করে থাকে। সেগুলো হলো- এনইবি-১ এবং এনইবি-২। হায়ালেটকে এদের পরবর্তী প্রজন্মের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিস্ফোরক বলা যেতে পারে।
‘টার্কি টুডে’-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, শক্ত কংক্রিট বা ইস্পাতের দেওয়াল কেটে ৯০ মিটার পর্যন্ত গভীরে ঢুকে হামলা চালাতে পারবে আঙ্কারার তৈরি নতুন এই বাঙ্কার বাস্টার বোমা।
এ বিষয়ে কুজুলু বলেন, ‘সাধারণ বাঙ্কার বাস্টার বোমাগুলো ১.৮ থেকে ২.৮ মিটার মোটা কংক্রিটের দেওয়াল কেটে ভেতরে ঢুকে আঘাত হানতে পারে। আমাদের বোমা কিন্তু তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এটা সাত মিটার পর্যন্ত পুরু কংক্রিট বা ইস্পাতের দেওয়াল ভেদ করে আঘাত হানতে সক্ষম। এতটা মোটা ইস্পাতের চাদর সাধারণত সেতু, বাঁধ বা পরমাণু হাতিয়ার রাখার পরিকাঠামোতেই ব্যবহার করা হয়।’
সম্প্রতি একটি দ্বীপে হায়ালেটের সফল পরীক্ষা চালান তুর্কি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এতে দেখা যায়, পাথর এবং মাটির মধ্যে ৯০ মিটার পর্যন্ত গভীরে প্রবেশ করেছে এই বাঙ্কার বাস্টার বোমা। কুজুলু জানিয়েছেন, ১৬০ মিটার চওড়া দ্বীপে ওই পরীক্ষা করা হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর দ্বীপের বাইরে আশপাশের এলাকাতেও এর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। গাজাপের পরীক্ষাতেও ১০০ শতাংশ সাফল্য মিলেছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে হায়ালেটকে ব্যবহার করতে পারবে তুর্কি বিমান বাহিনী। রি-ইনফোর্সড সি-৫০ কংক্রিটের ব্লক এবং ২৫ মিলিমিটারের রিবড স্টিলের খাঁচার ওপর এর শক্তি পরীক্ষা করা হয়। কতকটা আধুনিক দুর্গের আকারে ওই কংক্রিটের ব্লক এবং স্টিলের খাঁচা তৈরি করা হয়েছিল। পরীক্ষার পর দেখা যায় এর পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
তুর্কি গণমাধ্যমগুলোর দাবি, সংশ্লিষ্ট বাঙ্কার বাস্টার বোমাটি একাধিক ইস্পাতের খাঁচা উড়িয়ে দিতে সক্ষম। ১০ মিটারের ঘন বালির নীচের বাঙ্কারে ঢুকে অনায়াসে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে হায়ালেট। দেড় টনের কংক্রিটের দেওয়াল চিরে ৬০০ মিটার গভীরে গিয়ে শত্রুকে খতম করার ক্ষমতা রয়েছে তার।
এদিকে গত ২২ জুলাই প্রথমবার একটি হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাশ্যে আনেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ক্ষেপণাস্ত্রটির নাম রাখা হয়েছে ‘টাইফুন ব্লক-৪’। দেশটির অন্যতম বড় শহর ইস্তাম্বুলে চলা ‘আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা শিল্প মেলা ২০২৫’-এ প্রদর্শিত ওই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি নিয়ে ইতোমধ্যেই সামনে এসেছে একাধিক রিপোর্ট।
তুরস্কের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘টার্কি টুডে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘টাইফুন ব্লক ৪’-এর দৈর্ঘ্য সাড়ে ৬ মিটার। বিস্ফোরকবোঝাই অবস্থায় এর ওজন ২,৩০০ কিলোগ্রাম। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। হাতিয়ারটির নকশা তৈরি করেছে আঙ্কারার জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘রকেটসান’। এর উৎপাদনের সঙ্গেও জড়িত তারা।
দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। এ ব্যাপারে যাবতীয় দায়িত্ব ‘রকেটসান’-এর কাঁধে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। কয়েক বছর আগে ‘টাইফুন’ নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে আঙ্কারার ওই প্রতিরক্ষা সংস্থা। এত দিন পর্যন্ত সেটাই ছিল তুর্কি সেনার সবচেয়ে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
‘টার্কি টুডে’ জানিয়েছে, ‘টাইফুন’-এর উন্নত সংস্করণ হলো এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, যাকে প্রকাশ্যে আনার পর বিবৃতি দিয়েছে ‘রকেটসান’। সেখানে বলা হয়েছে, বহুমুখী ওয়ারহেড ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে এই হাতিয়ারের। শত্রুপক্ষের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, সামরিক বিমান রাখার হ্যাঙ্গারের মতো উচ্চমূল্যের কৌশলগত ফৌজি পরিকাঠামো ধ্বংসের জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তৈরি করা হয়েছে।
দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থার তৈরি ‘টাইফুন ব্লক ৪’-এর গতিবেগ অবশ্য প্রকাশ্যে আনেনি তুরস্ক। তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনুমান, আট ম্যাক (শব্দের গতিবেগের প্রায় আট গুণ) বেগে ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে পারবে আঙ্কারার এই হাতিয়ার।
এদিকে এমন একের পর এক মোক্ষম ‘হাতিয়ার’ তুর্কি সেনাবাহিনীর হাতে চলে আসায় ঘুম উড়েছে প্রতিবেশী গ্রিসের। কারণ, এথেন্সের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরেই সীমান্ত বিবাদ রয়েছে আঙ্কারার।
দ্বিতীয়ত, বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জেরে সাইপ্রাসকে পুরোপুরি কব্জা করতে পারে তুরস্ক। ১৯৭৪ সালে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির এক তৃতীয়াংশ জমি দখল করে নেয় আঙ্কারা। বর্তমানে সেখানে ‘টু স্টেট সলিউশন’-এর কথা বলেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান, যা খারিজ করে দিয়েছে সাইপ্রাস ও গ্রিস।
এদিকে তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পাকিস্তানের। কাশ্মীর ইস্যুতে বার বার ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছে আঙ্কারা। তাছাড়া রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ারও সরবরাহ করে থাকে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রশাসন। ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ‘বের্যাক্টার টিবি-২’ হামলাকারী ড্রোন দিয়ে সাহায্য করে তুরস্ক। যদিও সেগুলোকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করা হয় বলে দাবি ভারতের।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতকে শক্ত করতে পারেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তখন ইসলামাবাদের আক্রমণ ঠেকানো নয়াদিল্লির পক্ষে বেশ কঠিন হবে।