নিজস্ব প্রতিবেদক :
বর্ষার আগমনে আকাশ যখন মেঘে ঢেকে যায়, মাঠ-ঘাট পানিতে প্লাবিত হয়; তখন জেগে ওঠে গ্রামীণ জীবনের হাজারো অনুষঙ্গ। তারই একটি জীবন্ত নিদর্শন হলো চাঁই। বাঁশ দিয়ে তৈরি একধরনের মাছ ধরার ফাঁদ, যা বর্ষার জলে হয়ে ওঠে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গী।

চাঁই শুধু মাছ ধরার উপকরণ নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের‌ও প্রতীক। খাল-বিল, ধানক্ষেত কিংবা নদীর তীরে স্থাপন করা এই ফাঁদে ধরা পড়ে জলজ জীবনের স্বাদ। ধৈর্য, কৌশল আর সময়ের অপেক্ষায় চাঁই হয়ে ওঠে এক অনন্য গ্রামীণ চিত্র।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাঁইয়ের রয়েছে ভিন্ন নাম ও গঠন। সিলেট অঞ্চলে একে ‘কুই’ ডাকা হয়। কোথাও আবার বলা হয় ‘বইচনা’। আকারে বড় এবং চিংড়ি ধরার উপযোগী। জমির আইল কেটে কিংবা নদীর তীরে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে বসানো হয় এটি। বর্ষার নতুন জলে ভেসে আসা কৈ, শিং, বাইম, বড় চিংড়ি এতে আটকে পড়ে সহজেই।

চাঁই তৈরি নিছক কারিগরি কাজ নয়, এটি একধরনের সৃজনশীল শিল্প। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, সাহাপুর, সাতভাইয়াপাড়া ও রামগঞ্জ গ্রামের শতাধিক পরিবারের বেশি এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। গ্রামের নারীরা গৃহস্থালির কাজ সামলে ঘরে বসে চাঁই তৈরি করেন। যা তাদের আত্মনির্ভরতা ও পরিবারে বাড়তি আয় নিশ্চিত করে।

একটি মুলি বাঁশ থেকে সাধারণত চারটি ছোট চাঁই এবং মোটা বাঁশ থেকে প্রায় ২৫টি চাঁই তৈরি করা যায়। বাঁশ চিরে শুকিয়ে নিয়ে সূক্ষ্মভাবে বাঁধাই করে গড়ে তোলা হয় ফাঁদ। এর ভেতরে তৈরি করা হয় এক বা একাধিক খোপ, যাতে একবার মাছ ঢুকলে আর বের হতে না পারে।

চাঁইয়ের রয়েছে নানা ধরন। যেমন- ঘুনি চাঁই, কইয়া চাঁই, বড় মাছের চাঁই, জিহ্বা চাঁই, গুটি চাঁই ইত্যাদি। প্রতিটি চাঁই নির্দিষ্ট আকার, গঠন ও কাঠামো অনুযায়ী প্রস্তুত হয়। যাতে নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ সহজে ধরা পড়ে। ফাঁদের ভেতরে টোপ হিসেবে দেওয়া হয় রান্না করা ভাত, ধানের কুঁড়া কিংবা ঝিনুক-শামুক ভাঙা অংশ। যেন খাবারের গন্ধে মাছ আকৃষ্ট হয়ে ফাঁদে ঢোকে এবং আটকা পড়ে।

বর্ষা এলেই শুরু হয় চাঁই বসানোর উৎসব। গ্রামের ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে খাল-বিলে চাঁই বসিয়ে আসেন। কুয়াশায় মোড়া ভোরবেলায় চাঁই টেনে তুললে ভেতরে ধরা পড়া মাছের ঝলকানিতে আনন্দ জাগে। এটি শুধুই মাছ ধরার বিষয় নয় বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সরাসরি মেলবন্ধনের এক নিদর্শন।

যান্ত্রিক জীবনে চাঁই আজ কিছুটা হারিয়ে গেলেও দেশের বহু অঞ্চলে এটি এখনো বেঁচে আছে ঐতিহ্য হয়ে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণ, কাঁচামালের সহজলভ্যতা ও বিপণনের সুযোগ তৈরি হলে এটি সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ এ শিল্পকে নারী উন্নয়নের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে।