জাতীয়

জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় বাধা

  প্রতিনিধি ২৯ জুলাই ২০২৫ , ৬:২০:৩৯ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক :

জুলাই আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডাররা আহতদের চিকিৎসা নিতে বাধা দেন।

এসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনেরর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে।

এই মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এরইমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই অভিযোগপত্র আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম।

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় বাধা দেওয়া নিয়ে তথ্যের সূত্র হিসেবে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও ভিডিও প্রমাণ তুলে ধরে এতে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা এই চিকিৎসা সহায়তায় বাধা দেন। চিকিৎসা সহায়তা বাধাগ্রস্ত করার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়া, হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের তথ্য সংগ্রহ করা, যে রোগীদের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন, তাদের চিকিৎসা না দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

আন্দোলন চলাকালে চিকিৎসা দেওয়া কর্মীদের ভয় দেখানো হয়। এর অংশ হিসেবে চিকিৎসকদের দুর্গম অঞ্চলে বদলি করা হয়। গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো হাসপাতালগুলোতে অভিযান চালিয়ে মেডিকেল রেকর্ড জব্দ করে এবং আহতদের চিকিৎসা দেওয়া কর্মীদের মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করতে বা চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে চাপ দেয়।

চিকিৎসা সেবা ব্যাহত করার ফলে আহতদের জখম গুরুতর আকার ধারণ করে এবং অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ইঙ্গিত করে যে, পুলিশ প্রায়ই চিকিৎসা সহায়তা দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দিয়েছে। তেমনটা শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের মৃত্যুর ঘটনায় দেখা যায়।

গোয়েন্দা সংস্থাও হাসপাতালের নজরদারিতে অংশ নেয়। তারা গুলিবিদ্ধ রোগীদের শনাক্ত করে, চিকিৎসাকর্মী ও আহতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের আঙুলের ছাপ নেয়। কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের শনাক্ত ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতার প্রমাণ লুকাতে তারা চিকিৎসা-নথি ও অনেক হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ধ্বংস করে ফেলে।

আহত বিক্ষোভকারীদের যথাযথ চিকিৎসা না দিতে চিকিৎসাকর্মীদের ওপর চাপ দেওয়া হয়। আহতদের আঘাতের কারণ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ না করতে চাপ দেওয়া হয়। একাধিক সাক্ষ্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, এটি ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে করা হয়। এর মধ্যে হাসপাতাল পরিদর্শনে আসা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন।

নিরাপত্তা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন হাসপাতালে একই ধরনের বাধা দেয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ওপর মহল থেকে সব জায়গায় একই কৌশল অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।

একটি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসাবে রেকর্ড করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ না মানলে চিকিৎসাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। আরেকটি হাসপাতালে পুলিশের নির্দেশ ছিল যে, গুলিবিদ্ধ কাউকে ভর্তি যেন না নেওয়া হয়।

অন্য একটি হাসপাতালে আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য সরাসরি চিকিৎসকদের হুমকি দিয়ে আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। দুইজন চিকিৎসক সেই নির্দেশ না মানায় গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা তাদের গ্রেপ্তার করেন, এর ফলে অন্য আহতরা আতঙ্কে লুকিয়ে পড়েন।

আরেক হাসপাতালে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসকদের জেরা করে এবং নাম ঠিকানা লিখে রাখেন। আরেকটি হাসপাতালে ১৮ জুলাই একটি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ফোন করে চিকিৎসা বন্ধ করতে হুমকি দেয়।

ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সমর্থকেরা অনেক হাসপাতালের প্রবেশপথে উপস্থিত থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা আটকে দিতে পুলিশকে সাহায্য করেন। এসব তীব্র চাপের ফলে স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়।

অনেক আহত বিক্ষোভকারী বিশেষ করে যারা গুলিবিদ্ধ তারা বিভিন্ন চাপ ও ভয় প্রদর্শনের কারণে বেসরকারি হাসপাতালেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি। অন্যদিকে অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিজেদের ঝুঁকি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বিনা খরচেও আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।

এর মধ্যে রাজধানীর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কৌশলে নারী ওয়ার্ডে আহত পুরুষদের চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল হেলমেটধারী ছাত্রলীগের তল্লাশি থেকে বাঁচার জন্য।

এসব ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নং) করা হয়েছে। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান।

পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল-১।

৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।

আরও খবর

Sponsered content